You are currently viewing মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা
মসজিদ কি ? মুসলিম সমাজ জীবনে মসজিদের ভূমিকা, কর্তব্য ও রূপরেখা

মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা

মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা

মসজিদ একাধারে ইবাদত-বন্দেগীর স্থান, সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনায়তন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিচার ও সম্প্রীতি লেন-দেনের মিডিয়া, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সূতিকাগার।

সমাজ জীবনে মসজিদের গুরুত্ব ভূমিকা অপরিসীম। মসজিদ শুধু ইবাদত উপাসনার স্থান নয় বরং তা মুসলমানদের যাবতীয় কর্মকান্ড প্রাণকেন্দ্র। মসজিদ সমাজের সাংস্কৃতিক, ঐক্য-সংহতির কেন্দ্রভূমি।

মুসলিম জাতির ঈমান-আকীদা ইবাদত বন্দেগী হতে আরম্ভ করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শাসন-সংস্কার, রাষ্ট্র পরিচালনা, গবেষণা, সমস্যা নির্ণয় ও সমাধান চিন্ত এবং বাস্তবায়ন ও চর্চা কার্যকরী করার কেন্দ্ররূপে মসজিদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ সমাজ গঠনে মসজিদের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

১ : ইসলামী সমাজে মসজিদ।

পাঠ-২ : সমাজ জীবনে মসজিদের ভূমিকা।

পাঠ-৩ : শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মসজিদের অবদান।

পাঠ-৪ : মসজিদের ইমাম ও ইমামের গুণাবলী।
পাঠ-৫ : ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পাঠ-৬ : জুমুআর খুতবা ও এর বিষয়বস্তু।

ইসলামী সমাজে মসজিদ:

১. মসজিদের পরিচয় দিতে পারবেন।

২. মসজিদের গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারবেন।

১.১ মসজিদের পরিচয়

মসজিদের অর্থ ‘সাজদার স্থান’। ইসলামের পরিভাষায়- নামাযের জন্য ওয়াক্ফকৃত নির্দিষ্ট স্থানকে মসজিদ বলে। মসজিদকে ‘মহান আল্লহর ঘর’ বলা হয়ে থাকে। ‘সাজদাহ’ থেকে মসজিদ-এর উৎপত্তি। গঠন রীতি অনুসারে শব্দটি মাসজাদ হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু এর ব্যাপকার্থের কারণে মাসজাদ না হয়ে মসজিদ হয়েছে। কেননা, মসজিদ শুধু সাজদার স্থান নয়। এতে সালাতসহ আরও বহু কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। সেজন্য মসজিদ প্রম দিন থেকেই আল্লহর হক ও বান্দার হকের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মসজিদ মক্কার কা‘বা শরীফ। আর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ ‘মাসজিদুল আল আকসা’।

মসজিদ ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র এবং একটি পবিত্রতম স্থান। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদ একাধারে ইবাদাতবন্দেগীর স্থান, সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনায়তন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিচার ও সম্প্রীতি লেনদেনের মিডিয়া, নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সূতিকাগার। তাই মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১.২ মসজিদের গুরুত্ব

ক. আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে

মহান আল্লাহর ইবাদাতের ঘর হল মসজিদ। এখানেই একাগ্রচিত্তে করুণাময় আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকার উপযুক্ত স্থান। মুসলমানদের ধর্মীয় মিলনায়তন হলো মসজিদ। মুসলমান মসজিদে সমবেত হয়ে আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগী করার সাথে সাথে সেখানে ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা, ওয়ায-নসীহত প্রভৃতির জন্যও মিলিত হয়।

খ. ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণে

একটি সমাজের মুসলমান মসজিদে সমবেত হয় কেবল আল্লাহ্র নির্দেশে। তারা পরস্পরকে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তোলে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সুলভ আচরণ সৃষ্টিতে মসজিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি সমাজের মুসলমানগণ দৈনিক পাঁচবার মসজিদে মিলিত হয়ে আমীর-ফকির, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সবাই এক কাতারে একই ইমামের পিছনে একত্রিত হয়ে সকল ভেদাভেদ ও বৈষম্য ভুলে গিয়ে অপূর্ব সাম্যের নিদর্শন স্থাপন করে।

মসজিদে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক একত্রে নামায পড়তে সমবেত হয়। আর এ সুবাদেই পাড়া-প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর, পারস্পরিক পরিচিতি ও জানাজানি হওয়ার সুযোগ পায়।  মসজিদে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। পরস্পরের কথাবার্তা, কুশল বিনিময় ও আদর, শ্রদ্ধা, সম্ভাষণ, সালাম বিনিময় হয়। ফলে তাদের পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা, স্নেহ, শ্রদ্ধা ভালবাসা ও সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। এ কারণেই তারা একে অপরের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়।

গ. শান্তিও শৃঙ্খলাবোধ জাগরণে

মুসলমানগণ আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করণার্থে মসজিদে সমবেত হয়, তখন স্বভাবতই সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্র ভয়, ভালবাসা ও সন্তুষ্টি পাবার আশায় সকলে শান্তিও শৃঙ্খলা বজায় রাখে। অত্যন্ত নীরবতা ও ভাব-গম্ভীর পরিবেশে ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অতি শৃঙ্খলার সাথে নামাযের সব করণীয় আদায় করে।

মুসলমানগণ মসজিদে এসে যোগ্যতম ব্যক্তিকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তাঁরই ইমামতি বা নেতৃত্বে নামায আদায় করে। ইমামের নির্দেশ মুতাবিক মুক্তাদিগণ নামাযের সবগুলো কাজ সমাধা করে। আর এর মাধ্যমে নেতার নেতৃত্ব ও আনুগত্যের শিক্ষা লাভ হয়।

মসজিদ মানুষকে নিয়মানুবর্তিতাও শিক্ষা দেয়। একই নিয়মে দৈনিক পাঁচবার নামায আদায়, আযান-ইক্বামত এবং ইমামের পিছনে এ ধরাবাঁধা নিয়ম মাফিক সবকিছুই করার মাধ্যমে সকলকে নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তোলে।

মসজিদ মানুষকে সময়ানুবর্তিতারও শিক্ষা দান করে। নির্দিষ্ট সময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে সময়ানুবর্তিতা ও দায়িত্বজ্ঞান এবং কর্তব্যবোধ জাগ্রতকরার ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মসজিদ আল্লাহর ঘর বলে সেখানে সর্বদা পাক-পবিত্র অবস্থায় প্রবেশ করতে হয়। কাজেই আল্লাহ্র ইবাদতের জন্য মসজিদ পবিত্রতম স্থান হিসেবে চিহ্নিত। আর সমাজের সর্বত্র এ পবিত্র ভাবের বিস্তার ঘটাতে মসজিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ঘ. জনকল্যাণমূলক কার্যাবলীর ক্ষেত্রে

মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের সর্বপ্রকার জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী পরিচালনার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে মসজিদ।

জনহিতকর সকল কাজকর্ম পরামর্শের ভিত্তিতে মসজিদ থেকেই করা উচিত। মসজিদে নববীতে সর্বপ্রকার কাজই নবীজী (স) করতেন। মসজিদে পাঠাগার স্থাপন, শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করে সহীহ্ভাবে কুর‘আন-হাদীস শিক্ষার ব্যবস্থা করে সামাজিক সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে মসজিদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরক্ষরতা দূরীকরণার্থে মসজিদকে ব্যবহার করা খুবই শ্রেয়।

ঙ. মসজিদের অর্থনৈতিক ভূমিকা

মহানবী (স) মসজিদে নববীতে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের নির্দেশনা দিতেন। অর্থনৈতিক ব্যাপারেও তিনি নীতিমালা ঘোষণা করেছেন।

মসজিদে নববীতে গণীমাতের মাল এবং যাকাত ও সাদকার মাল জমা হত। মসজিদ থেকেই তা প্রাপকদের মাঝে বিলিবণ্টন করা হত। এ দৃষ্টিতে মসজিদ যেন ধনাগার ও বিতরণ কেন্দ্র। পরবর্তীকালে প্রত্যেকটি মসজিদেরই নিজস্ব বিরাট তহবিল গড়ে উঠেছিল। সেই তহবিল থেকে দান ও যাবতীয় সমাজকল্যাণমূলক কাজ করা হত।

সার-সংক্ষেপ :

মসজিদ ইসলামী সমাজের প্রাণকেন্দ্র। মসজিদকে বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম সমাজ কল্পনাতীত। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় মসজিদ একাধারে ইবাদাত গৃহ, শিক্ষাকেন্দ্র, মিলনায়তন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিচালনার কেন্দ্র। প্রখ্যাত পন্ডিত আলী তানতাভী মসজিদের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন: “মসজিদ হচ্ছে ইবাদাতের স্থান, পার্লামেন্ট, শিক্ষায়তন, মাজলিস ও আদালত।” আজকের বিশ্ব মুসলিম সমাজ মসজিদ কেন্দ্রিক জীবন হতে বিচ্যুত হয়েই ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যাবতীয় সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। এ শোচনীয় অবস্থা হতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে “মসজিদে নববীর” মত পুনরায় মসজিদগুলোকে আবাদ করা। তা হলে আজকে এ একবিংশ শতকেও আমরা সামাজিক সুখ, শান্তিও সমৃদ্ধির মুখ দেখতে পাবো।

 সমাজ জীবনে মসজিদের ভূমিকা:

১. সমাজ জীবনে মসজিদের ভূমিকা নির্ণয় করতে পারবেন।

২. সামাজিক সমস্যা সমাধানে মসজিদের কর্মসূচি তুলে ধরতে পারবেন।

২.১ সমাজে মসজিদের ভূমিকা

মসজিদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাস্তবরূপ। মসজিদে নববী ছিল আল্লাহর নবীর সামগ্রিক কর্মকান্ডের সদর দফতর। এমনকি বাসভবনও। মসজিদ শুধুমাত্র নামাযের ঘর ছিল না। মুসলিম সমাজের সকল

কর্মকান্ডের কেন্দ্র হচ্ছে মসজিদ।

ক. মসজিদ সামগ্রিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র

ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবারের পরেই মসজিদ হচ্ছে ইসলামী সমাজের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। এটাকে মুসলিম সমাজের সমষ্টিক কেন্দ্রও বলা যেতে পারে।

খ. মসজিদ মানবকল্যাণ কেন্দ্র

আল্লাহর ঘর মসজিদ শুধু সালাতের ঘরই নয়। এটা ফালাহ বা মানব কল্যাণ কেন্দ্র। তাই মুয়াযিযন পাঁচ বেলা মুসল্লীদেরকে শুধু সালাতের জন্য নয়, ফালাহ বা মানব কল্যাণের জন্যও আল্লাহর ঘরের দিকে আহŸান করে থাকে।

গ. সমাজকে মসজিদ কেন্দ্রিক করা

সমাজ ও জীবনকে মসজিদমুখী এবং মসজিদ কেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে পারলে সমাজের সব সমস্যার সমাধান এখান থেকেই হবে। মসজিদকে প্রাণবন্ত, জীবন্ত ও কর্মমুখর করে তুলতে হবে। মসজিদ কেন্দ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে জীবনের দৈনন্দিন চাহিদা যত বেশি সম্ভব মেটাতে হবে। মসজিদকে শুধু নামায ও কুরআন তেলাওয়াতের গৃহরূপে সীমিত রাখলে মসজিদ মরে যাবে।

ঘ. কল্যাণমূলক সকল কাজ মসজিদ কেন্দ্রিক

আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন শুধু পাঁচ বেলা নামাযই নয়, প্রতিটি কর্মেই মসজিদের প্রভাব থাকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হাজার চাহিদা আল্লাহর ঘর কেন্দ্রিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব হলে কৃতজ্ঞতায় মাথা স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর সামনে সাজদায় নত হবে। তখন আমাদের সকল শোকর-মুনাজাত প্রার্থনা হৃদয়ের উৎস মূল হতে উৎসারিত হবে। আর তখনই আল্লাহ তা কবুল করবেন।

২.২ সামাজিক সমস্যা সমাধানে মসজিদের ভূমিকা

মসজিদে নববীর ছায়াবলম্বনে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে মসজিদের ভূমিকার একটি কর্মসূচি এখানে তুলে ধরা হল-

১. সর্বপ্রকার গণকল্যাণের প্রাণকেন্দ্র

মসজিদ হবে আল-ফালাহ বা সর্বপ্রকার গণকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন ও সুষ্ঠু পরিচালনা করা, অন্যান্য মসজিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, মসজিদ কেন্দ্রিক কর্মসূচির সমন¦য় সাধন করা হবে এর কাজ।

২. প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র

মসজিদই হবে মুসলিম শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। নারী-পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলের জন্য বিশেষ করে দরিদ্র-অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কুরআন-হাদীস, বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা দানের জন্য ফোরকানিয়া মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

৩. উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা শুধু ফোরকানিয়া মক্তব নয়, উন্নত মানের শিক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা।

৪. শিক্ষা সামগ্রী প্রণয়ন মসজিদ এবং মসজিদ কমিটি কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পুস্তক রচনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব মসজিদ কমিটিকে গ্রহণ করতে হবে।

৫. শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা

মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা। মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের কর্যে হাসানা ও বৃত্তি প্রদান। সকল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার খরচ বহন করা। লেখাপড়া এবং গবেষণা করার মত পরিবেশ, ব্যবহারিক বস্তু সামগ্রী, উপকরণ এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা।

৬. সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা

মসজিদে সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত পাঠাগার স্থাপন করা। যাতে মৌলিক ও প্রেরণা সৃষ্টিকারী পুস্তকের পর্যাপ্ত সমাহার থাকে।ইসলামী আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি ও শিক্ষা সামগ্রী মসজিদ পরিচালিত পাঠাগারে সংরক্ষণ করা।

৭. পাঠ্যচর্চা ও সমষ্টিক পাঠ

মসজিদের মধ্যে এবং মসজিদের উদ্যোগে পাঠ চর্চা, সমষ্টিক পাঠের ব্যবস্থা করে পাঠের জন্য উৎসাহ, প্রেরণা ও পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করা।

৮. ওয়ায-নসীহত ও আলোচনা সভা

কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহের ওপর ওয়ায-নসীহত, আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম,ও গবেষণার ব্যবস্থা করা ও সুযোগ সৃষ্টি করা।

৯. পুস্তক রচনা ও প্রচার

ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিসমূহকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য মাতৃভাষায় ব্যাপক পুস্তক রচনা ও প্রকাশনাকে উৎসাহ দান করা। নাম মাত্র মূল্যে ব্যাপক বিতরণ করা।

১০. স্বাস্থ্য সেবা প্রদান

মসজিদ থেকে গণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি, পুষ্টি জ্ঞান দান করা এবং চিকিৎসা-সুবিধাসহ ঔষধ পত্র প্রদান করা। মসজিদ এলাকার লোকদের স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ, রোগ মুক্ত মহল্লা সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ, এলাকার রোগাক্রান্ত লোকদের খোঁজ-খবর নেয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থাকরণ, মসজিদ সংলগ্ন ডিসপেনসারী ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।

১১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গঠন

পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এ হাদীসের বাস্তবায়নের জন্য মসজিদ সংলগ্ন মহল্লা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব গ্রহণ এবং পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা। মসজিদের চারপাশে প্রাতঃভ্রমণের জন্য পথ ও স্থান সংরক্ষণ করা।

১২. সামাজিক সমস্যা সমাধান

মসজিদ সংলগ্ন মহল্লার জনগণকে মসজিদে একত্রিত করে তাদের সামাজিক সমস্যা ও উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করে সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং সমাধানে আত্মনিয়োগ করা।

১৩. সমস্যার মীমাংসা করা

মহল্লার কারো মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে বা কোন সমস্যা দেখা দিলে তাদের সমস্যার সমাধান করা। তাদের মধ্যে নিরপেক্ষ মীমাংসা করে দেয়া।

১৪. কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা

সমাজের বেকার যুবক ও মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপায় বের করা। এজন্য তাদেরকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র স্থাপন করা। ছোট ও মাঝারি শিল্পের প্রতিষ্ঠা করে অভাবগ্রস্ত, অসহায়, ইয়াতীম, বিধবা ও ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

১৫. উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সহায়তা

গ্রাম পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইমাম-মুয়াযিযনকে কৃষি, পশুপালন, মৎস্য চাষ, সমবায়, নলক‚প মেরামত প্রভৃতি বহুমুখি কলা-কৌশল প্রশিক্ষণ দান। অথবা সার্বক্ষণিক নিয়োগ দান এবং ঐ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা।

১৬. মসজিদ কেন্দ্রিক সমবায়

এলাকার মুসল্লীদের সমন¦য়ে সমবায় সমিতি গঠন করে বিভিন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এ সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি, মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগীর খামার, পশু পালন, বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা।

১৭. সমৃদ্ধ তহবিল গঠন

মসজিদকে বহুমুখি কর্মকান্ড আঞ্জাম দেয়ার জন্য এবং জনগণের আর্থিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যৌথভাবে ব্যবসায় বাণিজ্যে ও শিল্পে বিনিয়োগ ব্যবস্থা করা। জনগণের দান, স্টক শেয়ার, চাঁদা, ওয়াকফ জমি ও টাকা গ্রহণ করা। এগুলোর তত্ত্বাবধান ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা করা। অন্যান্য মানবতাবাদী সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য অনুদান গ্রহণ করা এবং মসজিদের আদর্শ বাস্তবায়নে সংস্থাকে দান-অনুদান, কর্জ এবং অন্যান্য রূপ সাহায্য করা। তহবিল থেকে জনগণকে করযে হাসানা সাহায্য ও অনুদান হিসেবে প্রদান করা।

১৮. নারী-কল্যাণ

মসজিদকে নারীর সামগ্রিক কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর শিক্ষা, নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, মসজিদে গমনের সুব্যবস্থা করতে হবে। নারীদের জ্ঞান-গবেষণার পরিবেশ দিতে হবে। নারীদের জন্য মসজিদে স্থান সংরক্ষণ করতে হবে। নারীদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান প্রসারের জন্য পাঠচর্চা, সামষ্টিক পাঠ, ওয়ায-নসীহত, সভা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত রাখতে ও করতে হবে। বিধবা, অসহায়, ইয়াতীম নারীদের বিবাহ- বিবাহোত্তর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। অসহায়-বিধবা, ইয়াতিম অভাবগ্রস্ত মহিলাদের প্রতিপালনের জন্য ঘর ও হোস্টেলের ব্যবস্থা করা।

১৯. সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি

মসজিদ মহল্লার সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করা। মসজিদের চারধারে বসবাসকারী ব্যক্তিগণ যাতে মান-সম্মান-ইজ্জত সহকারে বসবাস করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। মর্যাদাহীন, অশালীন ও অশোভনীয় কার্যকলাপ বন্ধ করে সুস্থ ও উন্নত পরিবেশ তৈরি করা।

২০. দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসা

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অগ্নিকান্ড প্রভৃতি বিপর্যয়ের ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য প্রদান করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী নিয়ে সাহায্যকারী দল গঠন, দুর্গত এলাকায় প্রেরণ, আশ্রয় শিবির স্থাপন ও মৃতদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা।

২১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধান করা

মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় বা মুসল্লীদের মধ্যে কি কি সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করা এবং জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বক্তৃতা বা খুতবার মাধ্যমে তা জানানো। মসজিদে স্থাপিত বোর্ডে তার তালিকা টাঙানো যেতে পারে।

২২. নৈতিক ও বৈষয়িক ট্রেনিং

মসজিদ এলাকার মুসল্লীদের চরিত্র গঠনের ট্রেনিং প্রদান যাতে চরিত্রবান, উপযুক্ত ও স্বাবলম্বী দক্ষ জনগোষ্ঠী গঠন করা যায়। যারা যুগ সমস্যার সমাধানে নিজেরাই এগিয়ে আসতে পারে।

২৩. মুসাফিরখানা বা অতিথিশালা

দূর-দূরান্ত থেকে আগত মুসল্লী বা পথিক-মুসাফিরদের থাকা-খাওয়ার জন্য মুসফির খানা বা অতিথি শালার ব্যবস্থা করা।

২৪. মসজিদের জায়গার ব্যবহার

মসজিদের জায়গা খালি রাখা ঠিক নয়। মসজিদের খালি জায়গায় ফলমূল, শাক-সব্জি লাগানো দরকার। ইমাম ও মুয়াযিযন তা ব্যবহার করতে পারেন। কিংবা তা থেকে মসজিদের আয়ের ব্যবস্থা করা যায়। অনুরূপভাবে কবুতর পালন, মধুর চাষ, পুকুর বা হাউজে তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন মাছের চাষ করে মসজিদের আয় বাড়ানো যেতে পারে।

সার-সংক্ষেপ

মসজিদ হচ্ছে মুসলিম সমাজের কল্যাণকেন্দ্র। তাই মসজিদকে সমাজের সামগ্রিক কর্মকান্ড ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। তবেই মসজিদ হবে জীবন্ত এবং মানুষের মিলন কেন্দ্র। মানুষের সবচেয়ে প্রাণের বস্তু। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় মসজিদের অবদান।

৩.১ মসজিদে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার

শিক্ষা বিস্তারে মসজিদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (স) ছিলেন মসজিদে নববীর মহান শিক্ষক ও মানবতার পথ প্রদর্শক।

মসজিদে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা প্রসঙ্গে নবী করীম (স) বলেছেন :

“কোন সম্প্রদায় যদি আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে কুর’আন পাঠ করে ও নিজেরা পরস্পরকে শিক্ষাদান করে, তাহলে তাদের ওপর শান্তিনাযিল হয়। আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে। ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং মহান আল্লাহ তাঁর নিকট উপস্থিত ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা আলোচনা করেন।” (মুসলিম) মহানবী (স) আরো বলেছেন : “যে আমাদের এ মসজিদে কিছু ভাল জিনিস শিখাতে কিংবা শিখতে আসে, সে যেন আল্লাহর পথের মুজাহিদ। আর যে এটা ব্যতীত মসজিদে প্রবেশ করে-সে যেন এমন জিনিসের দর্শক যা তার জন্য নেই।” (নাইলুল আওতার : ১৬৫ পৃ:)

৩.২ মসজিদ হচ্ছে গণবিদ্যালয়

রাসূলুল্লাহ (স) নিজে মসজিদে আল্লাহর আদেশ নিষেধ শিক্ষা দিতেন। তিনি মসজিদে সালাত ও অন্যান্য দ্বীনী তা’লীম দিতেন।। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, দেশী-বিদেশী সকলেই এতে সমানভাবে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেত। নিরক্ষরতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গণ শিক্ষা পরিচালনায় মসজিদ আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। মসজিদকে কেন্দ্র করে মক্তব গড়ে তোলা যায়। এখানে ইমাম, মুয়াযিযন সাহেবের কাছে ছোট ছেলে-মেয়েরা কালিমা, কালাম, সূরা-কিরাআত, কায়দা, কুরআন শরীফ পড়া শিখে। প্রয়োজনীয় মাসয়ালা মাসায়িল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন শিক্ষা দেয়া হয়। মসজিদ ভিত্তিক মক্তবের উপকারিতা ব্যাপক। এখানে আলাদা ঘর তৈরি করতে হয় না, মসজিদকেই মক্তব ঘরে হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া আলাদা কোন শিক্ষক রাখারও প্রয়োজন হয় না। ইমাম ও মুয়াযিযন সাহেব শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এখানে বড় একটি দিক হল- ইমাম সাহেবের মত চরিত্রবান ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছে শিক্ষা লাভ করে শিশুরা চরিত্রবান হয়ে গড়ে উঠবে। ইসলামের সোনালী যুগে মসজিদকে কেন্দ্র করেই বড় বড় লাইব্রেরী এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল।

৩.৩ গণশিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা

গণশিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা যায় অত্যন্ত সহজে। গ্রাম ও মহল্লার বয়স্ক লোকেরা মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। এতে নানা রকম সুবিধা ও সাশ্রয় হয়। এ জন্য যেমন কোন আলাদা জায়গা বা ঘর লাগে না, আলাদা শিক্ষক লাগে না। তেমনি আলাদা সময় নষ্ট হয় না। সালাত আদায় করতে এসেই শিক্ষা অর্জন করে যেতে পারেন। ইমাম সাহেব সাধারণত বয়স্ক ও সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হয়ে থাকেন। সুতরাং বয়স্ক লোকেরা তাঁর কাছে পড়তে কোন রকম দ্বিধা করবেন না। তাঁর শিক্ষা ও উপদেশে তাদের চরিত্রও উন্নত হবে। কাজেই নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও উন্নত সমাজ গঠনে মসজিদ অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে মসজিদকে কেন্দ্র করে সারা দেশ ও জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্ত করা যায়। জাতিকে স্বাক্ষরতা দান করার ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা অসাধারণ। সংশ্লিষ্ট  মহল বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন- দেশ ও জাতির জন্য ততদ্রুত মঙ্গল বয়ে আসবে।

সার-সংক্ষেপ

মসজিদে পাঠাগার স্থাপন, শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। সহীহভাবে কুরআন-হাদীস শিক্ষা দেয়া যায়। সামাজিক সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিরক্ষরতা দূরীকরণার্থে মসজিদকে ব্যবহার করা খুবই শ্রেয়। মহানবী (স) প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ছিল ইসলামের প্রম শিক্ষাকেন্দ্র। এ মসজিদ থেকেই প্রখ্যাত ওলামায়ে কিরাম, যুগশ্রেষ্ঠ, মনীষী, ফকীহ, মুহাদ্দিস, বিচারক, রাষ্ট্রনায়ক, ইমাম ও পথ প্রদর্শকগণ শিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁরা বিশ্ববাসীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় সমুদ্ভাসিত করেছেন।

মসজিদের ইমাম ও ইমামের গুণাবলী

  • ১.  ইমামের যোগ্যতা নিরূপণ করতে পারবেন

  • ২. ইমামের গুণাবলী ও বর্ণনা করতে পারবেন।

৪.১ ইমামের পরিচয়

ইমাম অর্থ নেতা, পরিচালক ও অগ্রনায়ক। ইসলামের সোনালী যুগে ইমাম বলতে বুঝাতো ইসলামী সমাজের সামগ্রিক নেতৃত্ব যাঁরা দিতেন তাদেরকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ-সভ্যতা, সমাজের পরিচালনার সামগ্রিক নেতৃত্বে ছিলেন ইমামগণ। ইমাম একটি অতীব মর্যাদা ও সম্মানের আসন। পরবর্তী কালে ইমাম শব্দটি ইসলামের ধর্ম-তাত্তি¡কদের ব্যাপারে ব্যবহৃত হতে থাকে। তাছাড়া মসজিদের যিনি সালাত নেতৃত্ব দেন, তাঁকেও ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসলামের সোনালী যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের যারা নেতৃত্ব দিতেন তাঁরাই আবার মসজিদের সালাতেরও নেতৃত্ব দিতেন। এজন্য সমাজ ও মসজিদের একই নেতা বা ইমাম ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন এক শ্রেণীর লোক যাঁরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদাসীন। আর মসজিদের ইমামতের দায়িত্বে রয়েছেন ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন লোক। এখন এদেরকেই ইমাম বলা হয়।

৪.২ ইমামের যোগ্যতা ও গুণাবলী

মসজিদে সালাতের নেতৃত্ব এবং সমাজের সংস্কার, উন্নয়নমূলক কার্য পরিচালনা ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে নেতৃত্ব দেয়ার মত উপযুক্ত ইমাম নিয়োগ করা প্রয়োজন। ইমাম হল নেতা। কাজেই নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্য ইমাম নিয়োগ করা খুবই জরুরি। মহানবী (স) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের মধ্যেকার সর্বোত্তম লোককে ইমাম নিযুক্ত কর। কেননা, তাঁরা তোমাদের এবং তোমাদের রবের মধ্যে প্রতিনিধিত্বকারী।” (দারে কুতনী) যোগ্য ইমাম নিয়োগের জন্য যথাযোগ্য সম্মানী প্রদান করা একান্ত অপরিহার্য। কেননা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ওপর সামাজিক মান-মর্যাদা নির্ভর করে। ইমাম সাহেবকে যেন অন্যের দয়া ও করুণার ওপর নির্ভর করতে না হয় সেদিকে অবশ্য খেয়াল করা দরকার। তাঁর সম মর্যাদার লোকদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁর সম্মানী নির্ধারণ অত্যাবশ্যক। মসজিদের ইমামগণের ন্যুনতম এ গুণগুলো অবশ্যই থাকতে হবে-

১. ইমামকে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কের অধিকারী, অনেকের জন্য উদাহরণ, সৎ কাজের আদেশ দানকারী, মন্দ কাজ থেকে বিরতকারী এবং সত্যের বাণী প্রকাশে সক্ষম হতে হবে।

২. সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে, লোক দেখানোর মনোভাব দূর করতে হবে, মানুষের প্রশংসা ও গুণকীর্তনে সীমালংঘন করতে পারবে না এবং এক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হবে।

৩. কুরআন ও হাদীসের সাথে সর্বদা সম্পর্ক রাখতে হবে এবং তা গভীর অধ্যয়ন করতে হবে ও প্রয়োজনীয় মাসলামাসয়েল উদ্ভাবন করতে হবে।

৪. সূক্ষ্ম বুঝ-জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, ব্যাপক লেখা-পড়া করা, যে সমাজে বাস করে সে সমাজ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হওয়া এবং সেই সমাজের অন্যান্য মতাদর্শ, দর্শন, চিন্তাধারা ও সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হবে।

৫. ইসলামের ইতিহাস এবং মানব সভ্যতার ইতিহাস জানতে হবে। এ ছাড়াও প্রাণী জগত এবং বিশ্ব সম্পর্কেও জানতে হবে।

৬. আরবি ভাষায় দক্ষতা ও পারদর্শিতা থাকতে হবে। ইংরেজিসহ আরো ২/১ টা বিদেশী ভাষা জানা থাকলে ইসলামের খিদমতে নিজকে আরো বেশী সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হবে।

৭. পর্যাপ্ত ইসলামী জ্ঞান থাকতে হবে। যেন যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামকে তুলে ধরা সম্ভব হয়। এর মধ্যে নামাযের মাসলা-মাসায়েলও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৮. উত্তম চরিত্র ও সুন্দর আচরণের অধিকারী হতে হবে। যাতে করে লোকেরা তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন এবং তার আহ্বানে সাড়া দিতে পারে।

৯. যথেষ্ট ধৈর্য ও সহ্যশক্তি থাকতে হবে। যেন মসজিদের পাড়া বা মহল্লার লোকদেরকে ইসলামী জ্ঞান দান করতে পারে।

১০. লোকের কাছে স্বল্পে সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং সে জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করতে হবে। তাতে লোকেরা তাঁকে সম্মান করবে ও ভালবাসবে এবং তাঁকে অপমান করার সাহস পাবে না।

১১. তাজবীদ সহকারে সুন্দর ও উত্তম কুরআন তেলাওয়াত জানতে হবে।

১২. সুন্দর ও পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে, যা মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এভাবে একজন ইমামকে সামগ্রিক দিক থেকে যোগ্যতম ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে। তা হলেই ইমামের দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে।

ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য

১.     ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করতে পারবেন।

২.     সামাজিক ক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশে−ষণ করতে পারবেন।

৫.১ ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্য –

ইমামকে সমাজের অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। ইমাম সাহেবের দায়িত্বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- ১. ইবাদতের নেতৃত্ব এবং ২. সমাজের নেতৃত্ব।

এ পর্যায়ে ইমাম সাহেবের দায়িত্ব-কর্তব্যের তালিকা হল-

ক. ইমাম সাহেবকে সালাতের নেতৃত্ব দিতে হবে।

খ. সঠিক সময়ে সালাত আদায় করতে হবে।

গ. সমাজের সকলকে নিয়ে জামাআতের সাথে সালাত আদায়ের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।

ঘ. সালাত সংক্রান্ত মাসলা-মাসায়েল মুসল্লীদের কে জানাতে হবে এবং মুসল্লীদেরকে সালাতের ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

ঙ. ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে নিজে অগ্রণী হবেন এবং মুসল্লীদেরকে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতে হবে।

চ. সালাতে উদ্বুদ্ধ এবং সালাত কায়েম রাখার জন্য মুসল্লীদেরকে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য এবং ওয়ায-নসীহত শোনাবেন।

ছ. অন্যান্য ইবাদত অনুষ্ঠানের যথাযথভাবে পালনের দিকে মুসল্লীদেরকে অবহিত করবেন। যেমন- রমযানের সাওম, তারাবীহ, ইফতার-সেহরী ইত্যাদির ব্যাপারে মুসল্লীদেরকে জানাবেন এবং এগুলো পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করবেন।

জ. হজ্জ পালনে মুসল্লীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। যারা হজ্জ পালনের উপযুক্ত, সেসব মুসল্লীদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের সাথে কথা বলবেন। তাঁদেরকে হজ্জ পালনে উদ্বুদ্ধ করবেন। হজ্জ পালনের মাসালা-মাসায়েল ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করবেন।

ঝ. যাকাত দানে উদ্বুদ্ধ করবেন। মুসল্লীদের মধ্যে যাঁরা যাকাত দিতে পারবেন তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করবেন। তাঁদের যাকাতের মাসয়ালা-মাসায়িল বলে দেবেন। তাঁদের যাকাতের হিসাবে সহযোগিতা করবেন। মসজিদ কেন্দ্রিক যাকাত উসূল করে তহবিল গঠন করবেন।

ঞ. মুসল্লীদের মধ্যে যারা অভাবী, অসহায় এবং যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত তাদের তালিকা প্রস্তুত করবেন। তাদের মধ্যে উসূলকৃত যাকাতের অর্থ সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করবেন। যাকাত ব্যয়ের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করবেন।

ট. ঈদের সালাতের ব্যবস্থা করবেন। ঈদের সালাতের গুরুত্ব, ফযীলত, মাসালা-মাসায়েল সম্বন্ধে মুসল্লীদের আগে থেকেই জানাবেন। উদ্বুদ্ধ করবেন। ঈদের দিনের করণীয়, ঈদের উদ্দেশ্য ও শিক্ষা সম্বন্ধে মুসল্লীদের বলবেন। ঈদের খুত্বায় মুসল্লীদের করণীয়, মুসলিম সমাজের করণীয় সম্বন্ধে জানাবেন।

ঠ. সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে মুসল্লীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। সাদাকাতুল ফিতরের গুরুত্ব, উদ্দেশ্য ও ফযীলত সম্বন্ধে মুসল্লীদের অবহিত করবেন। যারা সাদাকাতুল ফিতর দিতে পারবেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তা উত্তোলন করে তহবিল গঠন করতে পারেন। যারা তা গ্রহণ করার উপযুক্ত তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের মধ্যে বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থা করবেন।

ড. কুরবাণীর অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মুসল্লীদের উদ্বুদ্ধ করবেন। কুরবানীর মাসালা-মাসায়েল, ফযীলত শিক্ষা ও গুরুত্ব বুঝিয়ে দেবেন। মুসল্লীদের মধ্যে যারা কুরবানী করতে পারবেন, তাদের তালিকা প্রস্তুত করবেন। যারা কুরবানী দিতে অক্ষম তাদেরও তালিকা প্রস্তুত করবেন। অভাবী মুসল্লীগণ যাতে কুরবানীর গোশত পেতে পারেন এজন্য কুরবানী দাতাদেরকে আগেই উক্ত তালিকা প্রদান করবেন। অথবা, দানকৃত গোশত একত্রিত করে অভাবীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করবেন।

ঢ. কুরবাণীর চামড়া ও চামড়ার অর্থ দিয়ে মহল্লার মুসল্লীদের মাধ্যমে অনেক কল্যাণমূলক কাজ করা যায়। তাই কুরবানী দাতাদের তালিকা করে সকল চামড়া একত্রিত করে বিষয় করার ব্যবস্থা করবেন। বাজেট করে তা অভাবীদের মধ্যে বিতরণ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় করার ব্যবস্থা করবেন।

ণ. ইসলামী দিবসসমূহ উদ্যাপন করবেন। ইসলামী সাংস্কৃতিকমূলক অনুষ্ঠান পালন করবেন, সিরাতুন্নবী (স) পালন করবেন। শবে বরাত, শবে-কদর, শবে-মিরাজ, আশুরা ইত্যাদির গুরুত্ব, শিক্ষা, ফযীলত সম্বন্ধে আলোচনা সভা, সেমিনার, সেম্পোজিয়াম, রচনা প্রতিযোগিতা এবং আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।

৫.২ ইমামের সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য

ক. গণশিক্ষা ও নৈশবিদ্যালয় পরিচালনায় নেতৃত্ব দান

জাতি নিরক্ষরতা অভিশাপে জর্জরিত। তাই জাতিকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে গণশিক্ষা ও নৈশ বিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালনায় ইমাম সাহেবকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুসারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ওয়ায-নসীহত, বক্তৃতা ও উপদেশের মাধ্যমে সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সমাজ উৎসাহী যুবকদের সেবা-সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। ইমাম সাহেবকে নিবেদিত প্রাণ নেতার ভূমিকা পালন করতে হবে।

খ. সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা

সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, সমাজের খেদমতে কিছু কল্যাণমূলক অবদান রাখতে হবে। লোকদের অসুখবিসুখ, বিপদাপদে সেবা ও সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এতে ইমাম সাহেবের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ফলে সমাজ পরিচালনার নেতৃত্ব দান সহজ ও সফল হবে।

গ. সমস্যা সমাধানে নেতৃত্ব দান

ইমাম সাহেবকে সমাজের অন্যান্য সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। বর্তমানে আমাদের সমাজের অনেক সমস্যা বিদ্যমান। আজ সমাজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার অভাব কুসংস্কার ইত্যাকার বিভিন্ন সমস্যায় জর্জড়িত। এসবের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করার পর তা সমাধান করার চিন্তা করতে হবে। সমস্যা সমাধানের উপায়-পদ্ধতি নির্দেশ করতে হবে। সমস্যা সমাধানে সক্রিয় নেতৃত্ব ও সহযোগিতা করতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, যোগাযোগ, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি সমস্যা সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাধানের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

ঘ. পরিবেশ উন্নয়নে নেতৃত্ব দান

ইমাম সাহেব সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আত্ম কর্মসংস্থান পথ সৃষ্টি করার বা উপায় নির্দেশ করে ইমাম সাহেব বেকারত্ব দূরীকরণের জন্যও কাজ করতে পারেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য কাজ করবেন। স্বেচ্ছা-শ্রম ও স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে ছোটখাট রাস্তা নির্মাণ, পুল ও সাঁকো দেয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। এ সব কাজে ইমাম সাহেব সরাসরি নেতৃত্ব দিবেন এবং নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন। সমাজের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব। এই সমস্যাই আরও অনেক সমস্যা জন্ম দিচ্ছে। ‘পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে এর গুরুত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করে উদ্বুদ্ধ করবেন। পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনার বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। মসজিদ এলাকার নালা-নর্দমা পরিষ্কার, ডোবা-পুকুর পরিচ্ছন্নকরণ, ঝোপ-ঝাড় কর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মিত ব্যবস্থা করবেন। মুসল্লীদের শরীর, পোষাক ও বাসস্থান পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করবেন এবং এর গুরুত্ব ও ধর্মীয় ফযীলত বর্ণনা করবেন। তিনি নিজেও পরিষ্কারপরি” ছন্ন থাকবেন। একটি পরিচ্ছন্নতা দল গঠন করে নিয়মিত পরিদর্শনের কর্মসূচিও গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঙ. আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে দিক নির্দেশনা

মসজিদ এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে কী কী কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, ইমাম সাহেব তার দিক নির্দেশনা দিবেন। সেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত করার ফলপ্রসূ করার কার্যকরী ভূমিকা পালন করবেন। আত্ম কর্ম-সংস্থান সৃষ্টির জন্য সমবায়ের মাধ্যমে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগী খামার, দুগ্ধ খামার স্থাপন এবং শাক-সব্জি চাষ, বাগান, বৃক্ষ রোপণ, মধু চাষ, কবুতর পালন এবং আরও নানা ধরনের কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। ইমাম সাহেব জনগণকে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও ফযীলত বর্ণনা করে উদ্বুদ্ধ করবেন।

চ. সাময়িক বিষয় সম্পর্কে মুসল্লীদের অবহিত করণ

ইমাম সাহেব সচেতন ব্যক্তি হিসেবে সমসাময়িক বিষয় সম্পর্কে নিজে অবহিত হবেন এবং মুসল্লীদের তা জানাবেন।পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় যেমন ওজন স্তর, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করবেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্বন্ধেও খোঁজ-খবর রাখবেন এবং জনগণকে অবহিত করবেন। সমকালীন বিষয় সম্পর্কে মুসল্লীদের অবহিত করার সাথে সাথে এ ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করাও দরকার। যেমন-পরিবেশ দূষণের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বৃক্ষ নিধন বন্ধ এবং বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগের সময় এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময় কি করতে হবে, তার নির্দেশনা দিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করার কর্মসূচি নেবেন।

সার-সংক্ষেপ

এভাবে ইমাম সাহেবকে সমাজের সবচেয়ে বিচক্ষণ ও উত্তম নেতা ও পরিচালকের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই কেবল ইসলামী সমাজ ও মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে মানুষ উপকৃত হবে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার সুফল পেয়ে সবাই সুখী-সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারবেন। আর আল্লাহর শোকর আদায়ের জন্য লোকেরা আন্তরিকতার সাথে মসজিদ পানে ছুটে আসবে।

জুমুআর খুতবা ও এর বিষয়বস্তু

১.  খুত্বার গুরুত্ব আলোচনা করতে পারবেন

২.  জুমুআর খুত্বার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে পারবেন।

৬.১ জুমুআর খুতবার পরিচয়

খুত্বা মানে ভাষণ, বক্তৃতা ও উপদেশ। ইসলামী পরিভাষায় সাপ্তাহিক সালাত তথা জুমআর নামায এবং দু ঈদের সালাতে ইমাম সাহেব মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক বিষয় সম্বলিত উপদেশমূলক যে ভাষণ দিয়ে থাকেন তাকেই খুত্বা বলে। খুত্বা দান শ্রবণ উভয়ই ওয়াজিব। জুমআর খুত্বায় এলাকা ও দেশদশের সমস্যার কথা আলোচনা করে ইসলামের দৃষ্টিতে সবগুলোর সমাধান পেশ করতে হবে। বিশেষ করে দ্বীনী সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রাধান্য দিতে হবে। এছাড়াও স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। খুত্বা হচ্ছে বক্তৃতা ও উপদেশ। তাই প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহে পরামর্শ দিতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের প্রয়োজনীয়তা এবং ইসলামী আইন-কানূন কায়েমের জন্য সরকারসহ জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মুসলমানরা যে অন্য কোন মানব রচিত মতবাদ ও মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না তা বুঝিয়ে বলতে হবে। কেননা, আল্লাহর কাছে ইসলাম ছাড়া আর কোন মতাদর্শ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন : “আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দীন বা জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে, ইসলাম।” এ বিষয়টি লোকেরা জানে না বলেই তারা ভুলের মধ্যে আছে। তাদের ভুল ভাঙ্গাতে হবে।

৬.২ খুতবার বিষয়বস্তু

খুত্বা হচ্ছে দীনের দাওয়াত ও তাবলীগের উত্তম উপায়। তাই এর উপযুক্ত সদ্ব্যবহারের জন্য জাতীয় ভিত্তিক কোনপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সমনি¦ত খুত্বার মাধ্যমে একই দিন দেশব্যাপী সর্বাধিক সংখ্যক লোকের কাছে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে পরিকল্পিত দাওয়াত পৌঁছানো যায় ও বিভিন্ন বিষয়ে তাদেরকে ইসলামী জ্ঞান দেয়া যায়। তাই খুত্বার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বার্ষিক একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রতিমাসে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা যায়। খুতবা সম্পর্কে যে সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা বাঞ্চনীয় তা হলো-

ক. পরকালের শাস্তি ও পুরস্কারের বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং আমর বিল মারূফ ও নেহী আনিল মনকার অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে ওয়ায-নসীহত করা।

খ. ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা এবং সন্দেহ-সংশয় দূর করার চেষ্টা করা। পাশাপাশি ভ্রান্ত মতবাদ ও দর্শন থেকে দূরে থাকার বিষয়ে উপদেশ দেয়া এবং যুক্তি ও দলীল দিয়ে সেগুলোর ভ্রান্তি ও দুর্বলতা তুলে ধরে সেগুলোর ওপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করা। যেন মানুষ আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা ইসলামের ওপর টিকে থাকে।

গ. সমাজের চলমান সমস্যা ও সংকট আলোচনা করে ইসলামের দৃষ্টিতে সেগুলোর সমাধান পেশ করা। মহিলা ও পরিবারের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা দরকার।

ঘ. ইসলামের বিভিন্ন উপলক্ষ ও অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করা। যেমন, বছরে একবার করে ঘুরে আসে রমযান, হজ্জ, যাকাত, আশুরা, মিরাজ ইত্যাদি। মুসল্লীরা যেন সে সকল বিষয়ে জানার জন্য আরো বেশী আগ্রহী হয়।

ঙ. ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। এ ছাড়াও মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কেও আলোকপাত করতে হবে। যাতে করে মুসলমানরা তাদের অন্য জায়গার মুসলমানের ইয্যত-সম্মান, আকীদা-বিশ্বাস ও ইসলামী শরীআহর প্রতিরক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করে দাওয়াতে দ্বীনের পথের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।

ছ. কোন ব্যক্তি, দল বা প্রশাসনের প্রচারনার উদ্দেশ্য থেকে খুত্বাকে মুক্ত রাখতে হবে এবং তাকে একমাত্র আল্লাহ, দ্বীন, দাওয়াত ও আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট করতে হবে। কেননা, আল্লাহ বলেছেন, “এ মসজিদসমূহ শুধু আল্লাহর জন্য, তোমরা আল্লাহর সাথে আর কাউকে ডেকো না।”

জ. ওলামায়ের কিরাম এবং দায়ী’দের উচিত উন্নতমানের ইসলামী খুত্বার নমুনা তৈরি করা। সেগুলোতে কুরআন, হাদীস, ইসলামী ইতিহাস, নেক লোকদের বক্তব্য এবং ভাল ও ইসলামী কবিতার সাহায্য নিতে হবে। এতে করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইমামরা তা দেখে ভাল খুত্বাহ তৈরি করতে পারবেন।

ঝ. খুত্বা দানের সময় শব্দ ও ভাব-ভঙ্গি স্বাভাবিক হওয়া দরকার। চিৎকার, কৃত্রিম আওয়াজ ও গানের সুরে খুত্বা যেন না দেয়া হয়।

ঞ. খুত্বা যেন এ পরিমাণ দীর্ঘ না হয় যে, শ্রোতারা বিরক্ত হয়ে পড়ে। কিংবা এত সংক্ষিপ্ত না হয় যে, বিষয়বস্তু ঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।

ট. দু ঈদের খুত্বার মূলনীতিও জুমুআর খুত্বার বর্ণিত মূলনীতির অনুরূপ। তবে তাতে ব্যাপকতা থাকতে হবে এবং ইসলামের সাধারণ নীতিমালার উল্লেখ করতে হবে।

Leave a Reply